ইসলামি জীবন বিধানের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে রোজা/রমজান। আর তাই মুসলিমদের জীবন দর্শনের সাথে রোজা অংগাংগি ভাবে ইমোশনালী এবং ধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে’ কারণে’ই সুস্থ অসুস্থ সকল মুসলমানরাই রমজানের এ বিধিটি পালনে আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট থাকেন।

ডায়াবেটিস যেহেতু একটি সেনসেটিভ বিষয় তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের রোজা রাখবার জন্য একটু বার্তি সচেতন হয়ে নিজ নিজ ডাক্তারের সঠিক দিক নির্দেশনা মতো রোজার বিধি বিধান গুলো পালন করা প্রয়োজন।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা রোজা/ফাস্টিং করতে গিয়ে সাধারণত যে সকল চ্যালেঞ্জ বা রিস্কের সম্মুখীন হন সেগুলো :

  • রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা কমে যাওয়া বা’ বেড়ে যাওয়া (হাইপো-গ্লাই-সোমিয়া)
  • রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের জরুরী অবস্থা ( ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস)
  • পানি শূন্যতা রক্ত জমাটবদ্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

আর সেজন্যই এ সকল সমস্যা নিয়ে রোগীদের মনে নানাবিধ দ্বিধার সৃষ্টি হয়, যেমন:

# ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি কি রোজা রাখতে পারবেন?
# তার খাদ্য অভ্যাস কি হবে?
# রোজা রেখে চিকিৎসা বিধি ব্যবস্থা কেমন হবে?
# হাইপো-গ্লাই-সোমিয়া হলে কি করণীয়?
# ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা যাবে কি?
# রোজা রেখে ইনসুলিন নেয়া যায় কিনা?

পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা আল-বারাকা’তে উল্লেখ আছে যে

হে’ ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেদের উপর। যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পারো। – আয়াত: ১৮৪

তবে তোমাদের মধ্যে যে’ অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে তার পক্ষে যদি রোজা রাখা সম্ভব না’ হয় তবে সে’ অন্য সময়ে সেই রোজা সমূহ পূরণ করে নিবেন। অন্যদিকে রোজা গুলো যদি তার পক্ষে একেবারেই পালন করা সম্ভব না’ হয় বা’ কষ্টদায়ক হয়ে পরে তবে সে’ এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে। ইসলাম একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক পূর্ণাংগ জীবন বিধান মানুষের জীবনকে সহজ এবং শান্তিপূর্ণ করাই এর উদ্দেশ্য।

আর তাই অসুস্থ বা অক্ষম বা ওজর(যুক্তিযুক্ত কারণ) আছে এমন ব্যক্তিদের জন্য ইসলামের এই বিধানে যথেষ্ট ছাড়ের ব্যবস্থা রেখেছেন আল্লাহ-তা’আলা।

রমজান মাসে আমাদের ধর্মীয় এবং আত্মিক সুফলের পাশাপাশি রোজা রাখা / ফাস্টিং করা,সেহেরি এবং ইফতারে সঠিক ভাবে সুসম খাদ্য অভ্যাসের প্রাকটিসের ফলে সার্বিক ভাবে শারীরিক উপকারিতা এবং ঐশ্বরিক প্রশান্তি অর্জিত হয়। রোজা/ফাস্টিং এর ফলে শরীরে রক্তের গ্লুকোজ এর পরিমাণ কমে, রক্তের খারাপ চর্বি এবং ওজন কমে, দীর্ঘমেয়াদী শারিরীক নানা জটিলতা হ্রাস পায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, লিভার এবং পরিপাক তন্ত্রের কার্যক্রম বাড়িয়ে তোলে এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধে’ও বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফাস্টিং এর ফলে মানব শরীরের অন্ত্রের জীবাণু গুলোর বেশকিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটে।

আর তাই ফাষ্টিং/রোজা মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্য একটি প্রকৃতিক ডি-টক্সিকেশন পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রমাণিত। রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য ব্যবস্থাপনা মূলত স্বাভাবিক দিনের মতো করেই থাকবে, প্রতিদিনের খাবারকে ৩’ভাগে ভাগ করে নিতে হবে সেহেরি, ইফতার এবং সন্ধ্যা রাতের খাবার।

রমজানের পূর্বে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাভাবিক জীবন যাপনে যতটুকু খাবার খেতেন বা’ ক্যালোরি গ্রহণ করতেন ঠিক তেমনি রমজানে’ও খাবারের পরিমাণ ঠিকই থাকবে শুধু মাত্র সময়ের ব্যাবধন হবে।

যে বিষয় এড়িয়ে চলা উচিৎ:

  •  ইফতারে চিনি যুক্ত খাবার খাবেন না’
  •  খেজুর খাওয়া সুন্নত, খাওয়া যাবে কিন্তু অবশ্যই পরিমাণে কম।
  •  চর্বি এবং অধিক শর্করা খাবার বাদ দেয়া ভালো।
  •  মিষ্টি-জিলাপী-লাড্ডু-চিনি যুক্ত দই- চিনি দেয়া শরবত পরিহারযোগ্য।
  •  ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে যাওয়া অথবা খুবই কম পরিমাণ খাওয়া।

যে বিষয় গুলো মেনে চলা দরকার:

– ডাক্তারের পরামর্শে ইনসুলিন নেয়ার প্রয়োজন হলে মাগরিবের আজানের আগে অথবা ইফতারি গ্রহণের পূর্বে নেয়া যাবে।
– ডাবে পানি পাণ করবার চেষ্টা করুন।
– সালত-সবজী-ফলমূল সহ প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিন।
– একসঙ্গে বেশি পানি পাণ না’ করে একটু পর পর পানি পাণ করুন।
– ঔষধের ডোজ গুলো ডাক্তারের পরামর্শে রি-শিডিউল করে নিন।
– রাতের খাবার এবং সেহেরি কোন ভাবেই বাদ দেয়া উচিত হবে না’।

 

ব্যায়াম এবং হাটাচলা বা’ ফিজিক্যাল এক্টিভিটিস:

রোজা রেখে পরিমিত এবং স্বভাবিক হাঁটাচলা করুন এবং পাশাপাশি ইফতারির পূর্বে বা’ ইফতারির ২’ঘন্টা পরে হালকা ব্যায়াম করুন ফলে শরীর এবং মন উভয়ই চাংগা-হালকা ভাব অনুভূত হবে। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম পরিহার করুন। তারাবির নামাজ ও’ শারীরিক ব্যায়ামের উদ্দেশ্য কিছুটা পূরণ করে এবং পাশাপাশি আত্মিক প্রশান্তি দেয়।

 

রোজা রেখে ব্লাড সুগার পরীক্ষা এবং ইনসুলিন নেয়া যাবে কিনা:

ইসলামিক স্কলারেরা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে’ রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষা এবং ইনসুলিন নেয়া যাবে এর ফলে রোজার কোন সমস্যা হবে না’।

ডায়াবেটিসে আক্রাম্ত রোগী কখন রোজা ভেঙে ফেলবেনঃ

ইসলাম একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক পূর্ণাংগ জীবন বিধান। মানুষের জীবনকে সহজ করাই এর উদ্দেশ্য। ইসলামের কোন বিধান পালনে কারো অক্ষমতা থাকলে সে বিষয়ে ইসলামে যথেষ্ট ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা আছে।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ৩.৯০ মিলি মোল/লিঃ বা’ এর নিচে থাকলে অথবা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ৫.০০ মিলি মোল/লিঃ এর উপরে চলে গেলে রোজা ভেঙে ফেলবেন। অন্যদিকে দিনের বেলা যেকোন সময়ে গ্লুকোজের মাত্রা ১৬.৭০মিলি মোল/লিঃ বা এর বেশি হলে সাথে সাথে ইমিডিয়েটলি প্রস্রাবের কিটোন বডি চেক করতে হবে অবশ্যই। এছাড়াও রোজা রেখে ডায়াবেটিস রোগী যখনই কোন ধরনের শারিরীক অস্বস্তি বা খারাপ বা অসুস্থ বোধ করবেন সাথে সাথেই রোজা ভেঙে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার।

ইসলামিক ধর্মীয় বিধি-বিধানের সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা যেন নির্বিঘ্নে এবং সহজে ইসলামের এই ফরজ বিধানকে সম্পাদন করতে পারে সেজন্য রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের সমান আন্তরিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিশেষে সুস্থ-নিরাপদ-সুন্দর এবং অনন্দময় হোক সকলের জীবন এই প্রত্যাশা রইলো।

Leave a Comment